উপন্যাস

উপন্যাস ।। উপন্যাস ।। উপন্যাস ।। উপন্যাস

শেখর বসুর উপন্যাস সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত

“আধুনিক গল্প উপন্যাসের ধারায় শেখর বসু এক প্রতিষ্ঠিত নাম। সমকালীন পাঠক তাঁর লেখার প্রতি যেমন অনুরক্ত, তেমনি তাঁকে গ্রহণও করেছেন সর্বাংশে। এর মধ্যে কোনও আকস্মিকতা নেই। একটা দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা ও অবদান না থাকলে পাঠকের, বিশেষ করে এই সময়ের পাঠকের, মনোযোগ আকর্ষণ করা সম্ভব নয়।”

(লেখকের ‘উপন্যাসসমগ্র’ সম্পর্কে শারদীয় গল্পপত্র, ২০২০)

“শেখর বসু সেই ধরনের সাহিত্যিক যিনি গল্পের ওপর গল্প সাজান না। তাঁর লেখার বিস্তার ভিন্ন, সামান্য একটা সুর ক্রমশ অমোঘ হয়ে ওঠে। লেখার দর্শন পাঠককে সম্মোহিত করে রাখে…। বাংলা ছোটগল্প আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব যখন উপন্যাস লেখেন, তখন তাঁর উপন্যাস যে অনেক ছক ভাঙবে, নতুন দিশার হদিশ দেবে, তা স্বাভাবিক। মেদহীন গদ্য, কাহিনি ও দর্শনে শেখর বসুর উপন্যাস পাঠ আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে।”

(উপন্যাসসমগ্র ১ও ২।। সাপ্তাহিক বর্তমান, বইপাড়া)

সুখের খোঁজে

একেবারে চেনাজানা জগত্ থেকে গল্প উঠে আসে শেখর বসুর উপন্যাসে। গল্পের এমনই আকর্ষণীয় বয়ন যে, পাঠক চট করে জড়িয়ে যান গল্পের সঙ্গে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভেদরেখাটিও মিলিয়ে যায়। মনে হয়, যা ঘটেছে তা তো ঘটতেই পারে। ঘটনা-পরম্পরা, মনের কথা, হৃদয়রহস্য মিশে যায় একটি বিন্দুতে। এমন উপন্যাস চেনা সারির বাইরে, অথচ কী অপ্রতিরোধ্য তার টান। পাঠক, সমালোচকদের অনেকেই এ-কথা মানেন। উপন্যাস লেখার সূচনালগ্ন থেকেই এই স্বীকৃতি পেয়েছেন লেখক। বিশিষ্ট সমালোচক লিখছেন, “এমন কিছু উপন্যাস হাতে আসে, যা পড়তে পড়তে চমকে যেতে হয়। মুখ ফুটে বলতেই হয়, বাহ্‌! এটা তো অন্যরকম, ঠিক এভাবে আগে তো কেউ কলম ধরেনি। যেমন শেখর বসুর ‘অন্যরকম’। অন্যরকম অন্য ধাঁচের।”

(‘অন্যরকম’ উপন্যাস সম্পর্কে আনন্দবাজারের পুস্তক পরিচয়)

“বাংলা সাহিত্যে ‘ফিরে এলাম’কে ঠিক কোন উপন্যাসের গোত্রভুক্ত করব বুঝতে পারি না। আমার ধারণা, এর আগে বা পরে এমন অদ্ভুত মায়াবী উপন্যাস আর কেউ লেখেননি বাংলা ভাষায়। কাহিনিভাগ ক্ষীণ; উত্তমপুরুষে বর্ণিত এই কাহিনির অসুস্থ নায়ক দিনরাত এক ঘোরের মধ্যে থাকে। সেই আধো স্বপ্ন আধো জাগরণে বারংবার হানা দেয় এক কিশোরী, ইমতিয়ারপুর নামক এক রহস্যময় মফস্‌সলি শহর, একটা পোড়ো বাড়ি ও তার ভেতর অন্তহীন সিঁড়ি, নায়কের প্রথম যৌবনের টুকরো-টুকরো স্মৃতি এবং এক অনির্দেশ্য যাতনা।… উপন্যাসটি শেষ করার পরেই বুঝতে পারি আমাদের প্রত্যেকের বুকের ভেতর যে-একান্ত ইমতিয়ারপুর লুকিয়ে রয়েছে, সেখানে আমরা সব সময়ই পাড়ি দিয়ে চলেছি, অবিরাম।”

(‘সমালোচনাচর্চা’ গ্রন্থে শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায়)

উপন্যাস লেখা চলছে পাঁচ দশক ধরে

শেখর বসুর প্রথম উপন্যাসের নাম ‘সিঁড়ি’, একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। দিল্লির ‘প্রাংশু’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অন্যরকম’ প্রকাশিত হয় শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯৭৪ সালে। এটি ছিল আমন্ত্রিত উপন্যাস। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে গ্রন্থাকারে ‘অন্যরকম’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। ধারাবাহিক উপন্যাসও লিখেছেন বেশ কয়েকটি। রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে চারটি। সাপ্তাহিক বর্তমানে দুটি। এগুলির বাইরে একাধিক ধারাবাহিক লিখেছেন সানন্দা, তথ্যকেন্দ্র, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, ওয়েব ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে। নতুন ধারার গল্প লেখার পাশাপাশি নতুন ধরনের উপন্যাস লিখতেও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন লেখক। বিশ্বাস করেন, ছোটগল্পের সম্প্রসারণ উপন্যাস নয়, আবার উপন্যাসের সংক্ষিপ্তকরণও ছোটগল্প নয়। লেখকের ‘উপন্যাসসমগ্র’র প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। তৃতীয় খণ্ডের প্রকাশ আসন্ন। ‘ফিরে এলাম’ এবং ‘অন্যরকম’ উপন্যাসের লেখকের অন্যান্য উপন্যাসগুলি হলঃ ‘টেলিফোনে আত্মরক্ষা’, ১৯৮০। ‘আশ্চর্য মাকড়শা ও মায়া-মসলিন’, ১৯৮৬। ‘ত্রিমুখী প্রেম’, ১৯৯৩। ‘আকস্মিক অভিযান’, ১৯৯৪। ‘সুন্দর মুখের পরাজয়’, ১৯৯৭। ‘আজব মানুষের উপাখ্যান’,১৯৯৮।‘মধ্যরাতে স্বীকারোক্তি’, ১৯৯৯। ‘লুকনো চিঠি’, ১৯৯৯। ‘সাত নম্বর ঘরে’, ২০০০। ‘রেসকোর্সের পাশের রাস্তায়’, ২০০১। ‘সুখের খোঁজে, ২০০৩।

‘সাত ঘড়া মোহর’, ২০০৪। ‘তনুশ্রীর জীবন’, ২০১৯। ‘উপন্যাসসমগ্র ১ ; ২০১৯। ‘উপন্যাসসমগ্র ২ ; ২০২০।

ত্রিমুখী প্রেম

বাকি সব উপন্যাস ......

উপন্যাস নিয়ে কয়েকটি কথা

আমার প্রথম উপন্যাসের নাম ‘সিঁড়ি’। এটি ছাপা হয়েছিল একটি ছোট পত্রিকায়, ১৯৭২ সাল নাগাদ। উপন্যাসটি সম্পর্কে শুধু এইটুকু মনে আছে, কেমন যেন গ্রস্ত হয়ে লিখেছিলাম। বাস্তবের সঙ্গে কল্পজীবনকে মেশাবার চেষ্টা ছিল ওই লেখায়। কাহিনির প্রধান চরিত্র তার অতীতে ফেরার এক অসম্ভব চেষ্টায় মেতে উঠেছিল। হয়তো কিছুটা ফ্যান্টাসিও মিশেছিল এর মধ্যে। পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পরেও বেশ কিছুটা কাটাছেঁড়া করেছিলাম লেখায়। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালের কলকাতা বইমেলায়। ‘সিঁড়ি’র নাম পালটে দিয়ে রেখেছিলাম ‘ফিরে এলাম’। বইটি ছেপেছিল দিল্লির প্রাংশু প্রকাশন ।

‘অন্যরকম’ আমার দ্বিতীয় উপন্যাস, কিন্তু গ্রন্থাকারে বেরিয়ে গিয়েছিল আগেই—১৯৭৬ সালে। বইটি ছাপে আনন্দ পাবলিশার্স। ‘অন্যরকম’-এর প্রথম প্রকাশ ১৯৭৪ সালের আনন্দবাজার পূজা সংখ্যায়। আমন্ত্রিত উপন্যাস। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আনন্দবাজার শারদীয় সংখ্যা ও রবিবাসরীয় দফতরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রমাপদ চৌধুরী।

আমাদের ছোটগল্প নিয়ে আন্দোলন তখন শেষ পর্যায়ে। নতুন ধরনের ছোটগল্প নিয়ে ভাবনাচিন্তা, লেখালেখির পাশাপাশি নতুন ধারার উপন্যাস সম্পর্কেও আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এটা স্বাভাবিক। গল্প ও উপন্যাস দুটি আলাদা মাধ্যম, কিন্তু প্রকৃত বিচারে অখণ্ড লেখকব্যক্তিত্বকে উভয় ক্ষেত্রেই কমবেশি অনুভব করা যায়। তবে ছোটগল্পের সম্প্রসারণ উপন্যাস নয়, এবং উপন্যাসের সংক্ষিপ্তকরণও ছোটগল্প নয়। শুধু আকৃতি নয়, প্রকৃতিতেও অনেক তফাত। আধুনিক গল্প ও উপন্যাস সম্পর্কে আমাদের ধারণাও পালটে যাচ্ছিল। লক্ষ্য করে দেখেছি দেশ-বিদেশের গুণী লেখকরা গল্প-উপন্যাসের প্রচলিত ধারণা কী ভাবে ভাঙছেন । একদিকে ভাঙছেন, অন্যদিকে গড়ছেন। কারণ সাহিত্যের ইতিহাস ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। এই ইতিহাসে অনুকারীদের কোনও জায়গা নেই। লেখককে নিজের মতো হতেই হবে।

‘ফিরে এলাম’ উপন্যাসের কথায় ফিরি। কিছু পাঠক জুটেছিল প্রথম উপন্যাসটির। কিছু প্রশংসা পেয়েছিলাম। এক বিশিষ্ট সমালোচক তাঁর বইতেও ‘নতুন ধারা ও নতুন স্বাদের’ এই উপন্যাসটি সম্পর্কে বেশ কিছু ভালো ভালো কথা লিখেছেন।

আনন্দবাজার পূজাসংখ্যায় প্রকাশিত ‘অন্যরকম’ উপন্যাসেও অন্যরকম হওয়ার চেষ্টা ছিল পুরোপুরি। সেই সময়ের এক জ্বলন্ত রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসটি। আন্দোলন, ঘটনাক্রম ছায়া ফেলেছে আখ্যানে, কিন্তু জোর দেওয়া হয়েছিল ব্যক্তিমানুষের অন্তর্জীবনে।

এই দুটি উপন্যাস লেখার পরে উপন্যাসের জগতে একটু বোধহয় বেশি করে এসে পড়েছিলাম। ধারাবাহিক লিখেছি বেশ কয়েকটি। রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে অল্প সময়ের ব্যবধানে চারটি ধারাবাহিক উপন্যাস । একটি ধারাবাহিক ‘সানন্দা’য়। মধ্যিখানে সময়ের ব্যবধান ছিল সামান্যই, দুটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছি ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’-এ। এগুলির বাইরে একাধিক ধারাবাহিক লিখেছি তথ্যকেন্দ্র, উত্তরবঙ্গ সংবাদ,ওয়েব ম্যাগাজিন ইত্যাদিতে।

ধারাবাহিকের আলাদা একটা মজা আছে । অনেকটা সময় ধরে চলে বলে উপন্যাসের চালচলনে খানিকটা রদবদল চলে আসতে পারে । এমন কিছু বিষয় হয়তো গুরুত্ব পেতে পারে যা আগে হয়তো ঔপন্যাসিকের সচেতন চিন্তাতরঙ্গে ধরা পড়েনি। আমি বরাবরই খানতিনেক কিস্তি জমা দিয়ে ধারাবাহিক শুরু করেছি, এবং বরাবরই চেষ্টা করেছি ওই তিনটে কিস্তির ব্যবধান অটুট রাখতে। কিন্তু এমনই কপাল যে, ধারাবাহিকের প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে প্রতিবারই দিন আনি দিন খাইয়ের অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলাম। পরের সপ্তাহের ধারাবাহিক জমা দিচ্ছি আগের সপ্তাহে। তবে এটাও কপাল, কখনোই কিস্তি জমা দিতে ব্যর্থ হইনি।

ধারাবাহিক উপন্যাসের গুরু বলা যেতে পারে চার্লস ডিকেন্সকে। তিনি আবার ধারাবাহিক লেখার সময় পাঠকের প্রতিক্রিয়ার ওপর একটু বেশি মাত্রায় গুরুত্ব দিতেন। আগের কিস্তি সম্পর্কে পাঠকের মতামত জানার পরে পরের কিস্তি লেখায় হাত দিতেন। ডিকেন্সের ধারাবাহিকের আরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল—প্রতিটি কিস্তিই তিনি শেষ করতেন এমন একটি রহস্যময় মোচড় দিয়ে যে কাহিনির পরবর্তী অংশ জানার জন্যে পাঠকদের কৌতূহল টানটান হয়ে থাকত। এই কৌশলটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ক্লিফহ্যাঙ্গার’। পরবর্তীকালে ধারাবাহিক উপন্যাস লেখকদের অনেকেই এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করেছেন । কমবেশি সিদ্ধি এসেছে কারও-কারও, কিন্তু প্রতিভাবান ডিকেন্স ছিলেন তুলনাহীন। উনিশ শতকের শুরু থেকে বিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিক উপন্যাসের রমরমা ছিল। উপন্যাসে মূল ঘটনার পাশাপাশি কত অনুসারী ঘটনা ঘটত, তরঙ্গায়িত হয়ে উঠত ছোটবড় নানা বিষয়, কত এক থেকে তিন পুরুষের আখ্যান রচিত হয়েছে। শুধু একটা বছর নয়, ধারাবাহিক অনেকসময় বছরের পর বছর ধরে গড়াত। ওদিকে আবার একটি উপন্যাস নানা খণ্ডে লেখার রেওয়াজও তৈরি হয়েছিল । রমাঁ রোলাঁর ‘জঁ ক্রিস্তফ’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল মোট দশ খণ্ডে। উপন্যাসের এই সুদীর্ঘ বিস্তার অবশ্য পরের দিকে কমতে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে।