কর্মজীবনের সূত্রপাত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে। পরে ওই সংস্থারই প্রথম শ্রেণীর দুটি ইংরেজি দৈনিক ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ ও ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’-এ বারো বছর প্রধান সহ-সম্পাদকের কাজ। কর্মজীবনের পরবর্তী পর্যায়ে যোগ দেন ‘মাসিক আনন্দমেলা’য়। সবশেষে যুক্ত হন আনন্দবাজার পত্রিকার ওভারসিজ এডিশন ‘প্রবাসী আনন্দবাজার’ পত্রিকার সম্পাদনা বিভাগের সঙ্গে। ওই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত থাকাকালীন চাকরি থেকে অবসর নেন। এখন সম্পূর্ণ সময়ের লেখক। ‘শাস্ত্রবিরোধী ছোটগল্প আন্দোলন’-এর অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। নতুন ধারার গল্পলেখক হিসেবে চিহ্নিত ও সম্মানিত এই লেখকের আটটি গল্পগ্রন্থ আছে। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে সম্প্রতি-প্রকাশিত ‘পঞ্চাশটি গল্প’ ও দ্য কাফে টেবলের ’প্রিয় গল্প’ গল্প-সংকলনে লেখকের সব পর্বের নির্বাচিত গল্প পাওয়া যায়।
উপন্যাস রচনাতেও বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন শেখর বসু। ১৯৭৪ সালে শারদীয় আনন্দবাজারে পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘অন্যরকম’ স্বতন্ত্র ধারার উপন্যাস হিসেবে অভিনন্দিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি সম্পর্কে আনন্দবাজার পত্রিকার পুস্তক পরিচয় বিভাগে লেখা হয়ঃ “এমন কিছু উপন্যাস হাতে আসে, যা পড়তে পড়তে চমকে যেতে হয়। মুখ ফুটে বলতেই হয়, বাঃ! এটা তো অন্যরকম, ঠিক এ ভাবে আগে তো কেউ কলম ধরেনি।’’ লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘সিঁড়ি’, পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। এটি ‘ফিরে এলাম’ নামে দিল্লির ‘প্রাংশু’ প্রকাশনা থেকে ১৯৮৩ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বিশিষ্ট লেখক ও সমালোচক শান্তনু গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘সমালোচনাচর্চা’ গ্রন্থে এই উপন্যাসটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। লিখেছেন, “আমার ধারণা, এর আগে বা পরে এমন অদ্ভুত মায়াবী উপন্যাস আর কেউ লেখেননি বাংলা ভাষায়।” লেখকের উপন্যাসের সংখ্যা কমবেশি ত্রিশটি। উল্লেখযোগ্য অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে আছে ‘তনুশ্রীর জীবন’, ‘সাত ঘড়া মোহর’, ‘সুখের কাছে’ ইত্যাদি। ‘দ্য কাফে টেবল’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে সম্প্রতি লেখকের উপন্যাসসমগ্রর দুটি খণ্ড প্রকাশিত—‘উপন্যাসসমগ্র ১’ ও ‘উপন্যাসসমগ্র ২’। এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে তৃতীয় খণ্ডের প্রকাশ আসন্ন।
রহস্য-উপন্যাস রচনাতেও নিজস্ব ধারা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন লেখক। আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে লেখক চারটি ধারাবাহিক রহস্যকাহিনি লিখেছেন। রহস্যকাহিনিগুলি পাঠকমহলে বিপুল আলোড়ন ফেলেছিল। প্রথম রহস্যকাহিনি ‘অপরাধী চিহ্ন রাখেনি’ ; দ্বিতীয় ধারাবাহিক ‘রহস্যের পাঁচ ঠিকানা’। তৃতীয় ধারাবাহিক ‘ব্যবসার নাম শুভবিবাহ’ ; চতুর্থ ধারাবাহিক ‘জলে দস্যু ডাঙায় বাঘ’। প্রথম ও তৃতীয় ধারাবাহিক আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে ধারাবাহিক বেতারনাট্য হিসেবে সম্প্রচারিত হয়। ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’, ‘সানন্দা’,‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ’ ইত্যাদি পত্রিকাতেও রহস্যকাহিনি লিখেছেন লেখক। সম্প্রতি ‘প্রতিভাস’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে ‘রহস্য উপন্যাস’গুলি চারটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। খণ্ডগুলিতে মোট রহস্য উপন্যাসের সংখ্যা বারো। এই প্রকাশনা সংস্থা থেকে পঞ্চম খণ্ডের প্রকাশ আসন্ন।
বড়দের লেখালেখির জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ছোটদের জন্যও কলম ধরেছেন লেখক। সাফল্য এসেছে সূচনালগ্নেই। কী ভাবে ছোটদের দুনিয়ায় এলেন, সে কাহিনি শোনা যাক লেখকের কাছেই। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘ছোটদের পঞ্চাশটি গল্প’ সংকলনের ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, “ ১৯৭৫ সাল। … সেই সময় ছোটদের পত্রিকা ‘আনন্দমেলা’র সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একদিন হঠাত্ আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি আনন্দমেলার জন্যে একটা গল্প দাও তো।’ উত্তরে আমতা-আমতা করে বলেছিলাম, ‘কিন্তু আমি তো কখনও ছোটদের জন্যে লিখিনি।’ সম্পাদক একটু ধমকেই বললেন, ‘লেখোনি তো কী হয়েছে? লেখো। সামনের মাসেই গল্পটা চাই।’ … এক মাস নয়, দু’মাস বাদে ছোটদের জন্যে আমার প্রথম গল্পটি লিখে ফেললাম। গল্পের নাম ‘ভাগ্যিস ইনু ছিল’। এটি আনন্দমেলায় ছাপা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে। শুরু হল আমার ছোটদের জন্য গল্প লেখা। ওই বছরেই আনন্দমেলা পূজাসংখ্যায় লিখলাম ‘নিমগাছের কাক’ । ১৯৭৬-এ সাধারণ সংখ্যায় ‘শানুর কথা’, পুজোয় ‘ঝুমুর’। ১৯৭৭ সালে আনন্দমেলা পূজাসংখ্যায় আমার প্রথম ছোটদের উপন্যাস ‘সোনার বিস্কুট’। ব্যস, এই ভাবেই জড়িয়ে গিয়েছিলাম ছোটদের লেখার সঙ্গে।” লেখকের উল্লেখযোগ্য ছোটদের বইয়ের মধ্যে আছে ‘সোনার বিস্কুট’, ‘ইয়েতির মুখোমুখি’, ‘সাত বিলিতি হেরে গেল’, ‘ওরা যখন পাঁচজন’, ‘দুঃখী ডাকাত’, ‘চোর এসে বই পড়েছিল’, ‘ভূতেরা মোটেই ভিতু নয়’, ‘গোয়েন্দার চোখ’, ‘ভূতেরা চাউমিন ভালোবাসে’ ইত্যাদি।
শেখর বসুর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধের বই আছে, বেশির ভাগই সাহিত্যবিষয়ক। ‘সাহিত্য প্রতিচ্ছায়া’র লেখাগুলি প্রায় এক বছর ধরে আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল । আনন্দ পাবলিশার্স থেকে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। একাধিক সংস্করণের পরে নিঃশেষিত বইটি সম্প্রতি ‘প্রতিভাস’ প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। লেখকের অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে আছে ‘অন্তরঙ্গ জীবন ও সাহিত্য’, ‘ সাহিত্য, সাধনা ও সঙ্গিনী’, ‘লেখা ও লেখক’, ‘শ্রেষ্ঠ শিল্পী বারোজন’, ‘ডুবোজাহাজে নেতাজি’ ইত্যাদি গ্রন্থ।
অনুবাদ-কর্মেও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন লেখক। উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্মের আছে ‘বারোটি কিশোর ক্লাসিক’, ‘চেখভের হাসির গল্প’ ‘প্রেমচন্দের জীবনী’, ‘সুভাষচন্দ্রের সমগ্র রচনাবলী, তৃতীয় খণ্ড’, পিটার ওয়ার্ড ফে-র ‘বিস্মৃত সেনাবাহিনী’র অংশবিশেষ, কালাহানের ‘অ্যাড্রিফ্ট‘-এর সারানুবাদ ‘মহাসাগরে ছোট্ট ভেলায় ৭৬ দিন’ ইত্যাদি। সম্পাদনা করেছেন ‘শ্রেষ্ঠ বিদেশি গল্প’, ‘শাস্ত্রবিরোধী গল্প’, ‘মনীষী জীবনকথা’, ‘আধুনিক রবীন্দ্রনাথের একুশটি গল্প’ । ‘সেদিনের কলকাতা’য় পুরনো কলকাতার স্মৃতিচিত্রের সঙ্গে লেখকের আত্মকথারও মিশ্রণ ঘটেছে। ইউরোপ সফরের সময় ভিয়েনায় গিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর স্ত্রী এমিলি শেঙ্কেলের সুদীর্ঘ সাক্ষাত্কার নেন লেখক। এরই ভিত্তিতে রচিত হয়েছে ‘নেতাজির সহধর্মিণী’, যা এমিলির প্রথম জীবনকথা হিসেবে গৃহীত। লেখাটি প্রথমে আনন্দবাজারের বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়, পরে গ্রন্থাকারে ছাপা হয় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছেন সুদীর্ঘ ভ্রমণকথা ‘মার্ক টোয়েনের দেশে’ লেখকের গ্রন্থসংখ্যা অর্ধশতকেরও বেশি। দশটি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন।